পূর্বধলা উপজেলা ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোণা জেলার একটি প্রশাসনিক এলাকা।
অবস্থান ও আয়তন
পূর্বধলা উপজেলার আয়তন ৩০৮.০৩ বর্গ কিঃমিঃ। এ উপজেলা ৯০˙ ২৯˝ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ হতে ৯০˙ ৪৪˝ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২৪˙ ৪৮˝ দক্ষিণ অক্ষাংশ হতে ২৫˙ ০২˝ দক্ষিণ অক্ষাংশে অবস্থিত। এই উপজেলার উত্তরে নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলা এবং ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলা ,দক্ষিণে ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলা,পূর্বে নেত্রকোণার সদর উপজেলা,পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর ও হালুয়াঘাট উপজেলা।
🔴 নামকরণের ইতিহাস
১৮৭৪ সাল থেকে পূর্বধলা উপজেলা সুসঙ্গ দুর্গাপুর পরে নেত্রকোণা সদর থানার একটি ফাড়ি থানা ছিল। ১৯১৭ সালের ২১ আগস্ট সেক্রেটারী গর্ভমেন্ট অব বেঙ্গল এইচ, জে, টিনামের আদেশক্রমে পূর্বধলাকে পূর্ণাঙ্গ থানা (পুলিশ স্টেশন) প্রতিষ্ঠা করেন। সে সনে পূর্বধলা থানার আয়তন ছিল ১২৪ বর্গ মাইল । জনসংখ্যা ছিল ১১০.২৫৫ জন । এক সময়কার সুসঙ্গ পরগনা ভুক্ত ছিল পূর্বধলা। পূর্বধলা, ঘাগড়া, বাঘবেড়, নারায়ণডহর, মুক্তাগাছা, সুসঙ্গ ও শেরপুরের জমিদারদের শাসনাধীন ছিল। মোঘল আমল থেকেই অত্র উপজেলায় সংস্কৃতির ছোঁয়া লাগে। উক্ত সময়ে অত্র উপজেলার সোনাই কান্দা ও লালচাপুর গ্রামে নির্মিত মসজিদ দু’টি অত্র এলাকার জনগণের স্থাপত্যশৈলীতে দক্ষতার পরিচয় বহন করে। তাছাড়া হোগলা ইউনিয়নের নৃসিংহ জিউ আখড়া এবং ঘাগড়া ইউনিয়নে অবস্থিত রাজপাড়া মন্দির অত্র উপজেলার জনসাধারণের উন্নত ধর্মীয় সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। পাগল পন্থি করম শাহ্ এবং তার পুত্র টিপু শাহ্ এই উপজেলার লেটিরকান্দা গ্রামে ১৭৯২ সালে বসতি স্থাপন করেন এবং এই গ্রাম থেকেই পাগল পন্থি বিদ্রোহ ও কৃষক বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। এই উপজেলায় প্রায় ১৩০ একর বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও মনোরম রাজধলা নামক একটি বিল আছে। জনশ্রুতি আছে উক্ত বিলের পূর্ব পার্শ্বে তৎকালীন থানা গঠিত হওয়ায় অত্র থানার নামকরণ করা হয় পূর্বধলা থানা । পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে পূর্বধলা থানা পূর্বধলা উপজেলায় উন্নীত হয়।
🔴 সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
পূর্বধলা্র সংস্কৃতি ও জীবনধারায় নিম্নলিখিত উপকরণগুলো বিদ্যমানঃ
সমাজ ব্যবস্থা :
এ উপজেলায় ধর্মাবালম্বী লোকের বসবাস সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম, ২য় পর্যায়ে হিন্দু ও ৩য় পর্যায়ে খ্রীস্টান । তবে খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা গারো সম্প্রদায়ের। এরা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত । মুসলিম সমাজের দাই সম্প্রদায়ের বেশ কিছু পরিবার কয়েকটি গ্রামে (যেমন কালডোয়ার, কুতিউড়া,গনকপাড়া গ্রাম) বসবাস রয়েছে। এরা পৃথক সমাজ গঠন করে বসবাস করে।
গীত :
পূর্বধলা গ্রামীণ বিয়েগুলোতে মেয়েরা বিয়েরগীত পরিবেশন করে। বিয়ের গীতগুলো বেশীর ভাগই মিলন অথবা বিরহ শ্রেণীর।
লোক ধাঁধা :
লোক ধাঁধা পূর্বধলা গ্রাম সমাজে প্রচলিত ছিল। বয়স্ক মানুষের মুখে এখনো লোক ধাঁধা পাওয়া যায়।
যেমন-
০১. লড়বড় লড়বড়, সেফ দিয়া খাড়া কর । উত্তর : সুইয়ে সুতা পরানো ।
০২. গেছলাম আনতাম, বটা নাই ধরতাম । উত্তর : ডিম।
০৩. জঙ্গন থাইকা আনলাম বুড়ি, চোখ তার আটার কুড়ি। উত্তর- আনারশ।
এসকল লোকধাঁধা গুলো বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনের ঘরে প্রবেশের সময় কনের সখীরা এ রূপ ধাঁধার উত্তর চায়।
লোক কিস্সা :
পূর্বধলা লোক কিস্সা মঞ্চায়ন হতো । গফুর বাদশা ও বানেছা পরীর পালা একসময় খুব জন প্রিয়তা অর্জন করেছিল। পূর্বধলা সদরের নয়াপাড়া গ্রামের বড় আবু ঐ পালার কাহিনীকার।
লোক ক্রীড়া :
মেয়েলী খেলার মাঝে উল্লেখযোগ্য থাপড়ি, বৌডুঘু, মোলাবাড়ী। বিশেষ করে শিশুরা পুতুল বিয়ে, খেলানাতিবাড়ী ( মিছে মিছি রান্না) ইত্যাদি । ছেলেরা দারিয়াবান্দা, গোল্লাছুট, চুট্টিয়াবাড়ী, হাডুডু, ছাপখেলা, মার্বেল ইত্যাদি।
🔴 দর্শনীয় স্থান :
১। নারায়ন ডহর জমিদার বাড়ী- পূর্বধলা উপজেলা সদর হতে ০৫ কিঃমিঃ পূর্বদিকে অবস্থিত।
২। বাঘবেড় জমিদার বাড়ী- পূর্বধলা উপজেলা সদর হতে ০৪ কিঃমিঃ উত্তর পূর্বদিকে অবস্থিত।
৩। রাজধলা বিল- পূর্বধলা উপজেলা সদর সংলগ্ন উত্তর পশ্চিম কোণে অবস্থিত।
৪। হযরত টিপু শাহ ও করম শাহ মাজার- পূর্বধলা থেকে মোটরসাইকেল বা রিকশা যোগে কাপাসিয়া বাজার। সেখান থেকে ৩কিঃমিঃ পূর্বদিকে উক্ত মাজারের অবস্থান।
৫। সুনাইকান্দা প্রাচীন জামে মসজিদ- পূর্বধলা উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নে অবস্থিত। যেভাবে যাবেন- পূর্বধলা উপজেলা পরিষদ হতে মোটরসাইকেল বা রিকশা যোগে কাপাসিয়া বাজার। সেখান থেকে ১কিঃ মিঃ পুর্বে উক্ত মসজিদের অবস্থান।
🔴 জনসংখ্যার উপাত্ত
পূর্বধলা উপজেলার মোট জনসংখ্যা-৩,১০,৮৩৪ পুরুষ-৪৯.২৭%, মহিলা-৫০.৭৩%। মুসলমান-৯৪.৮০%, হিন্দু-৪.৮১%, বৌদ্ধ ও খৃষ্টান- ০.১৯% ও অন্যান্য-০.২০%।
এখানে গারো ও হদি নামক দু’টি আদিবাসী সম্প্রদায় আছে। তাদের পরিবাবেব সংখ্যা- ৪৪৫টি।
🔴 নদ-নদী :
কংস নদী :
ভারতের তুরা পাহাড়ে বিভিন্ন ঝর্ণার সম্মিলনে কংস নদীর উৎপত্তি। শেরপুরের হাতিবাগার এলাকা দিয়ে কংস বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উৎপত্তি স্থল থেকে শেরপুরের নালিতাবাড়ী পর্যন্ত এ নদীটির নাম ভূগাই। নালিতাবাড়ীর ৫মাইল ভাটিতে এসে দিংঘানা, চেল্লাখালী, দেওদিয়া মারিসি, মলিজি নামে উপনদী গুলো ভূগাইয়ের মিলিত হয়েছে। ভূগাই সে স্থানে বেশ খরস্রোতা হলে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে ফুলপুরের কাছাকাছি এসে খড়িয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। খড়িয়া ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী। ফুলপুর উপজেলার পর থেকে ভূগাই নদীটি কংস নামে খ্যাত। মেঘালয় থেকে শিববাড়ীর পাশ দিয়ে নিতাই নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ধোবাউড়া সদর হয়ে দুর্গাপুরের শঙ্করপুরের কাছে নিতাই কংস নদীতে মিলিত হয়েছে। এতে কংস তার পূর্ব পথের গতির চেয়ে অনেকাংশে বেড় গেছে। নেত্রকোনা জেলার ভেতরে পূর্বধলা উপজেলায় কংসের দৈঘ্য ৯ মাইল। দুর্গাপুর, ধৌবাউড়া ও পূর্বধলা উপজেলার সীমানা বরাবর ২০ মাইল। নেত্রকোনা সদর উপজেলায় ৬ মাইল। নেত্রকোনা সদর, বারহাট্টা সীমানা বেয়ে ৭ মাইল। বারহাট্টা উপজেলায় কংসের দৈঘ্য ১১ মাইল। বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ সীমানা বেয়ে ৬ মাইল। মোহনগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার সীমানা বরাবর ১৯ মাইল প্রবাহিত হয়ে ঘোরাউৎরা নদীতে মিলিত হয়েছে। নেত্রকোনা জেলার ভেতর অনেক শাখা নদী কংস নদী থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। পূর্বধলার সীমানোয় কংস থেকে একটি শাখা নদী দক্ষিণ দিকে ছুটে গিয়ে ধলাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। যা কালিহর নদী নামে পরিচিত। কালিহর এর শাখা নদী খানিগাঙ। এক সময় খানিগাঙ বেশ খরস্রোতা ছিল। এখর মরাগাঙ। এর মধ্যে জারিয়া বাজারের পূর্বদিক দিয়ে শলাখালী শাখা নদীটি বেরিয়ে ধলামূলগাঁও ইউনিয়নের ভেতরদিয়ে লাউয়ারী নামে ত্রিমোহনীতে এসে মগড়া নদীতে পতিত হয়েছে। নেত্রকোণার পূর্ব ইউনিয়ন ঠাকুরাকোণা বাজারের পাশদিয়ে বরাবর দক্ষিণাদিকদিয়ে আটপাড়া উপজেলার পাশে এসে মগড়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এ নদীটিতে তেমন পানি প্রবাহ থাকেনা। বর্ষায় বেশ থরস্রোতাহয়।
মগড়া নদী :
ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে মগড়ার উৎপত্তি। সেনেরচর নামক স্থান থেকে খড়িয়া নদী বেয়ে সারাসরি মগড়া নদীর প্রবাহ। সে প্রবাহ ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বুড়বুড়িয়া বিলে এসে পতিত হয়েছে। বুড়বুড়িয়া বিল থেকে বেরিয়ে গজারিয়া ও রাংসা নদীর স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়ে ফুলপুরের ঢাকুয়া নামক স্থানের ভেতর দিয়ে সরাসরি পূর্বদিকে ধলাই নামেপ্রবাহিত হয়েছে। পূর্বধলা উপজেলার হোগলা বাজারের পাশ দিয়ে পূর্বধলা সদরের ভেতর দিয়ে ত্রিমোহনী নামক স্থানে এসে দক্ষিণেপ্রবাহিত হয়েছে। ত্রিমোহনীতে এসে ধলাইয়ের সঙ্গে উত্তর দিক থেকে এসেলাউয়ারী নদী মিলিত হয়েছে। সে স্থান থেকে মগড়া নামে পরিচিত। সেখান থেকে প্রথমে পাঁচ মাইল পর্যন্ত দক্ষিণেদিকে প্রবাহিত হয়ে দয়াগঞ্জ ঘাট থেকে সরাসরি পূর্ব দিকে আকাঁবাকা হয়ে নেত্রকোনা শহরের পাশ দিয়ে আটপাড়া উপজেলার দিকে চলে গেছে। পশ্চিম দিক থেকে শ্যামগঞ্জ হয়ে দয়াগঞ্জ ঘাটের কাছে মগড়ার সঙ্গে ধলাই নামের একটি স্রোতধারা মিলিত হয়েছে।নেত্রকোনা জেলার ঠাকুরাকোণা থেকে কংস নদী একটি শাখা নদী আটপাড়ায় মগড়ার মিলিত হয়েছে। গৌরীপুর দিক থেকে ছুটে আসা পাটকুড়া নদীটি বসুর বাজার এলাকায় এসে মগড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সাউডুলি, মগড়া ও পাটকুড়ার মিলিত স্রোতেকেন্দুয়ার গুগবাজার কাছে এসে যোগ হয়েছে। সেখানে বর্ষায় স্রোতে প্রবাহ আনুপাতিক হারে বেশি থাকে। গুগবাজার হয়ে সে নদীটি মদন হয়ে ধনু নদীতে পতিত হয়েছে।নেত্রকোনা জেলায় মগড়া নদীর গতিপথ সব চেয়ে বেশি। এ নদীটি কোথাও ধলাই নামে কোথাও মগড়া নামে খ্যাত। এ জেলার চারশ বর্গ মাইল এলাকা দিয়ে মগড়া নদীর প্রবাহ রয়েছে। মগড়া কংস নদী ৮/১০ মাইল ব্যবধানে প্রায় ৪০ মাইল সমান্তরায় ভাবে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে।
🔴 প্রশাসনিক এলাকা
পূর্বধলা উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন রয়েছে, এবং ৩৩৪ টি গ্রাম রয়েছে। সম্পূর্ণ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম পূর্বধলা থানার আওতাধীন।
🔴 পৌরসভা: নাই
🔴 ইউনিয়নসমূহ: ১১টি ইউনিয়ন
হোগলা
ঘাগড়া
জারিয়া
ধলামূলগাঁও
পূর্বধলা
আগিয়া
বিশকাকূনী
খলিশাউড়
নারান্দিয়া
গোহালাকান্দা
বৈরাটি
🔴 পূর্বধলা থানা গঠিত হয় ১৯১৭ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালে।
🔴 পূর্বধলা উপজেলার পোস্ট কোড ২৪১০।
🔴 পূর্বধলা হানাদার মুক্ত দিসব ৯ ডিসেম্বর।